ধরলা নদীর ভাঙ্গনে গৃহহারা অর্ধশতাধিক গ্রামবাসী
আব্দুর রাজ্জাক রাজ, ফুলবাড়ী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি:
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের চর গোরকমণ্ডপ এলাকায় ধরলা নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর টানা কয়েকদিনের ভারি বর্ষণে সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে বটে তবে তীব্র ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। এরইমধ্যে প্রায় ৩০ টি পরিবার, কয়েকশ বিঘা চলমান আবাদি জমি ও প্রায় এক কিলোমিটার সড়ক নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। হুমকির মুখে ২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ের মুজিব কেল্লাও। গত বছরের ২ হাজার জিওব্যাগ এবং এ বছরের ১ম বন্যা থেকে শুরু হওয়া এ পর্যন্ত প্রায় ৪ হাজার জিওব্যাগ দিয়েও ভাঙ্গন ঠেকানো যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে স্থানীয় বানভাসিরা।
আজ (২৯-০৮-২৩ ইং) সরেজমিনে গিয়ে দেখতে পাওয়া যায়, এ যুদ্ধে হেরে যাওয়া মৃত জোবেদা খাতুনের ছেলে বদিউজ্জামানের (৫০) আহাজারি । বদিউজ্জামান বলেন, “প্রায় নয় বছর আগে মা মারা গেলে বসত ভিটাতেই মাকে কবর দেই । নদী তখন অনেক দূরেই ছিল । কিন্তু প্রতি বছরের বন্যায় নদী ভাঙ্গনের ভয়াল কবলে আমরা ধীরে ধীরে গৃহহারা হয়ে যাই । মা জীবিত থাকতে কখনও পানিতে ভাসতে দিলাম না । আর আজ মা (মায়ের কবর) চোখের সামনেই পানিতে ভেসে গেল । কিছুই করতে পেলাম না । গত দু-একমাস হয় বসতভিটা হারিয়ে আশ্রয়ণে (আবাসনে) আশ্রয় নিয়েছি । সেখান থেকে এসে এসে মায়ের কবর দেখে যেতাম । এখন থেকে আর মায়ের কবরটাও দেখতে পারবো না ।”
এ ভাঙ্গনের স্থান থেকে মাত্র ১০০ মিটার দূরে হানিফ (৫৫) আলীর বসত ভিটা এবং উক্ত ১০০ মিটার তারিই চলমান আবাদি জমি । তিনি হৃদয় ভাঙ্গা বেদনা নিয়ে বলেন, আমাদের অবস্থা বদিউজ্জামানের মত হতে যাচ্ছে শীঘ্রই । সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আমাদের আর কেউ বাঁচাতে পারবেন না ।
ভাঙ্গনের দাড়প্রান্তে এসে দাড়িয়েছে শুক্কুর আলী, জহুরুল ও ছাড়াতন বেগমের বসতবাড়ীসহ আশেপাশের আরও প্রায় ২৫ টি পরিবারের বসতভিটা । তারা নিরবে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে বোবা কান্না করছে । তাদের অনেক আশা ধরলা নদীর এ করাল গ্রাস থেকে শেষ আশ্রয়টুকু রক্ষা করা ।
উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ুয়া ছাত্র শাহ সুলতান দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের বাড়ী নদী পার থেকে ২০০ মিটার দূরে হলেও রাতে ঘুম আসে না । কখন যে আমাদের সিরিয়াল আসে বলা যায় না । তিনি বলেন এখন সময় আছে নদী ভাঙ্গনের হাত থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে আমাদের এর করাল ও ভয়াল গ্রাস থেকে রক্ষা করা । সময় থাকতেই যেন কর্তৃপক্ষ ভাঙ্গন রোধের ব্যবস্থা করেন ।
এ বিষয়ে চর গোড়ক মন্ডপের ওয়ার্ড মেম্বার জনাব আয়াজ উদ্দিনের সাথে কথা বললে তিনি এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, গত জুলাই মাসের বন্যার পরপরেই ডিসি স্যার, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা, ইউএনও স্যার,উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় চেয়ারম্যান এসে সরেজমিনে তদন্ত করে যাওয়ার পর প্রায় ৪ হাজার জিওব্যাগ বরাদ্দ করে এবং ভাঙ্গনরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন যা চলমান রয়েছে । কিন্তু হঠাৎ করে আবার বন্যা শুরু হওয়াতে আবার নদী ভাঙ্গন শুরু হয়েছে । উনারা বিষয়টা সম্পর্কে অবগত আছেন ।
এ বিষয়ে এ উপজেলার ইউএনও স্যার ও স্থানীয় চেয়ারম্যান সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলে তাঁরা বলেন, এখন পর্যাপ্ত বরাদ্দ নেই, বরাদ্দ প্রক্রিয়াধীন । বরাদ্দ আসলেই আমরা ভাঙ্গন রোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবো ।
পানি উন্নয়ন বোর্ড কুড়িগ্রামের এ উপজেলায় দায়িত্বরত উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী-২ জনাব ইসমত ত্বোহা বলেন, ‘মঙ্গলবার সকাল ৯ টায় তিস্তার পানি ডালিয়া ব্যারেজ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩৫ সে.মি. নিচ দিয়ে এবং কাউনিয়ায় বিপৎসীমার ১৫ সে.মি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর ফলে পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ কিছুটাও কমলেও ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে তারা।’ তিনি আরও বলেন, ফুলবাড়ী উপজেলাধীন নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের চড় গোড়ক মন্ডপের ধরলা নদীর এ ভাঙ্গনরোধের জন্য একটি “মিনি প্রকল্প” খুবেই দরকার । এ “মিমি প্রকল্পে”র জন্য ৪৮ হাজার জিওব্যাগ দরকার যা দিয়ে ৬০০ মিটার নদী ভাঙ্গন রোধ করা সম্ভব । কিন্তু সেখানে আমরা মাত্র ৪ হাজার জিওব্যাগ বরাদ্দ পেয়েছি । যা দিয়ে এ ভাঙ্গন কিছুতেই রোধ করা সম্ভব নয় । এই মূহুর্তে আমাদের নিকট কোন বরাদ্দ নেই , তাই আমরা ইনস্টান্ড ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারতেছি না । চাহিদা দেওয়া আছে বরাদ্দ আসলেই আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবো ।
তবে ভুক্তভোগী ও অসহায় এসব ধরলা ও বারোমাসিয়া নদী ভাঙ্গনের স্বীকার মানুষের দাবি ‘‘সার্বক্ষণিকভাবে জলমগ্ন ও ভাঙ্গন আক্রান্ত এলাকাসমূহ তদারকি করলে এবং মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন সতর্ক থাকলে যখন যা প্রয়োজন হবে, তখন তা পৌঁছে দিলে হয়তোবা আমার আজ বাস্তু, গৃহ হারা ও মায়ের কবর হারা হতাম না ।”
দৈনিক আলোর প্রতিদিন এর প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না