বরগুনায় এতিমদের টাকা সভাপতি ও বাবুর্চির পকেটে!

৯ জুন ২০২৩, ১২:০২:৩১

এম.মোরছালিন,বরগুনা প্রতিনিধি,

এতিম মাত্র দুজন, কিন্তু ক্যাপিটেশন বরাদ্দ ১৮ জনের। বরগুনায় হাজী ফকরউদ্দিন নেছারউদ্দিন শিশু সদনে কাগজ কলমে নামমাত্র এতিম দেখিয়ে লক্ষাধিক টাকা সভাপতি ও বাবুর্চির পকেটে। এতিম না থাকায় এতিমদের জন্য দেয়া সরকারের লাখ লাখ টাকা যাচ্ছে মাদ্রাসার এমনি দুর্ণীতিগ্রস্থদের হাতে। ফলে আত্মসাৎ হচ্ছে সরকারের লাখ লাখ টাকা।

বরগুনার বেতাগী উপজেলার কাজিরাবাদ ইউনিয়নে ইউনিয়ন পরিষদের সামনে অবস্থিত হাজী ফকরউদ্দিন নেছারউদ্দিন শিশু সদনটি। এই সদনটিতে ১৮ জন এতিমের জন্য ক্যাপিটেশন বরাদ্দ দিয়েছে সমাজসেবা অধিদপ্তর। সরকারী নিয়ম অনুযায়ী শিশু সদনে ১৮ জনের বরাদ্দ পেতে হলে এতিম থাকতে হবে ৩৬ জন । কিন্তু বাস্তবে এই সদনে রয়েছে মাত্র দুজন, এদের মধ্যে একজন এতিম। শুধু এখানেই নয়, জেলার অধিকাংশ এতিমখানাতেই দেখা যায় এমন চিত্র।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতায় হাজী ফকরউদ্দিন নেছারউদ্দিন শিশু সদনটি ক্যাপিটেশন প্রাপ্ত হয় ২০০৩ সালে। চলতি অর্থবছরে ৩৬ জন এতিম রয়েছে বলে তালিকা দেয়া হয় সমাজসেবা অধিদপ্তরে। এর অনুকূলে ১৮ জনের ক্যাপিটেশন পায় সদনটি। প্রতি ৬ মাসে ২ লাখ ১৬ হাজার টাকা বরাদ্দ পায় প্রতিষ্ঠানটি। এক বছরে যা দাড়ায় ৪ লাখ ৩২ হাজারে। তবে দুজন এতিম ছাত্র থাকার পরেও সাত দিন আগে ১৮ জনের জন্য বরাদ্দের টাকা পায় প্রতিষ্ঠানটি।

হাজী ফকরউদ্দিন নেছারউদ্দিন শিশু সদনের মাসুম ও হাসান নামে দুজন ছাত্র বলেন, বিগত তিন বছর আগে আমরা ২০-২৫ জন ছিলাম। কিন্তু আমাদের হুজুর চলে যাওয়ায় তার সাথে অনেক ছাত্রই চলে গেছে। বাকি যারা ছিল তারা বাড়িতে গেছে ছুটি নিয়ে। এখন আমরা দুজন ছাত্র আর দুজন হুজুর আছি।

এতিমখানার বাবুর্চির দায়িত্বে থাকা মো: ইব্রাহীম হোসেন বলেন, বরাদ্দের ব্যাপারে আমি কিছু জানিনা। সভাপতি এসব বিষয়ে বলতে পারবে। আমাদের হুজুর চলে যাওয়ায় অনেক ছাত্র চলে গিয়েছে। আবার অনেকে বাড়িতে ছুটিতে আছে।

এসব বিষয় নিয়ে যাতে সংবাদ প্রচার করা না হয় সেজন্য এতিমখানা কতৃপক্ষ সাংবাদিকদের ঘুষের প্রস্তাব করেন। বাবুর্চি মো: ইব্রাহীম সরাসরি ঘুষের প্রস্তাব দিয়ে বলেন, নিউজ করার দরকার নাই, অনেক সাংবাদিক এখনে আসে। আপনারা আপনাদের ভিজিটিং কার্ড ও বিকাশ নম্বর দিয়ে যান, আপনাদের সাথে পরে দেখা করব।

এ বিষয়ে বেতাগী উপজেলা সমাজসেবা অফিসার মাসুম বিল্লাহর কাছে মুঠোফোনে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা মাঠপর্যায়ে পর্যবেক্ষণ করে এতিমখানাগুলোয় বিল প্রদান করেছি। এতিম ২ জন থাকার পরেও কিভাবে বরাদ্দের টাকা দিয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সাংবাদিকদের টাকা দিয়েছেতো মাদ্রাসা কতৃপক্ষ, আপনারা পাননি? আমি ট্রেনিং এর জন্য ঢাকায় অবস্থান করছি। বেতাগী এসে এবিষয়ে আপনাদের সাথে কথা বলবো।

এ বিষয়ে বরগুনা জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো: সহিদুল ইসলাম বলেন, এ জেলায় এতিমদের তুলনায় এতিমখানা অনেক বেশি। আমাদের কঠিন নির্দেশনা রয়েছে ভূইফোর এতিখানাগুলোর বিরুদ্ধে। যেসকল এতিমখানায় এতিম নেই সে সকল এতিমখানায় যাতে বিল না দেয়া হয় সেজন্য আমার কার্যালয় থেকে চিঠি দেয়া আছে এবং মৌখিক নির্দেশনা দেয়া আছে।

তিনি আরও বলেন, কাজিরাবাদের এতিমখানাটি আমি সরাসরি পরিদর্শন করব। যদি সেখানে এতিম না পাওয়া যায় তবে পরবর্তী বিল বাতিল করা হবে এবং এতিম না থাকার পরেও কিভাবে চলতি ছয়মাসে বিল দেয়া হল সংশ্লিষ্ট সমাজসেবা কার্যালয়ের কাছে ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হবে।

এছাড়াও বরগুনায় অনেকগুলো এতিমখানা সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় এতিমখানা আছে এতিম কম। যাদের নামের তালিকা যাচ্ছে সমাজসেবায় তারাও এতিমখানায় নেই। এতিমদের ভুয়া নাম ব্যবহার করে চলছে এতিমের বরাদ্দের টাকা আত্মসাতের পাল্লা। আবার যেসকল এতিমখানায় এতিমের সংখ্যা বেশি সেই প্রতিষ্ঠানগুলোয় এতিমের বরাদ্দ পাচ্ছে না। বরগুনা জেলায় জুলাই-২০২২ থেকে ডিসেম্বর-২০২২ পর্যন্ত ৪ হাজার ৬০৯ জন এতিমের অনুকূলে ৫ কোটি ৫৩ লাখ ০৮ হাজার টাকা সরকারি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, বরগুনা জেলায় ১২০ টির মতো এতিমখানা রয়েছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশেরই তালিকা অনুযায়ী এতিম নেই। কোথাও কোথাও এতিম থাকলেও মাসিক বেতন দিয়ে থাকতে হচ্ছে তাদের। অথচ এসব এতিমদের তালিকা দেখিয়ে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা।

দৈনিক আলোর প্রতিদিন এর প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না